কেউ বা কারা যেন বুদ্ধি খাটিয়ে বার করেছে যে শহরে গাছ না রাখার একমাত্র ভালো উপায় খোলা মাটি না রাখা। সেই উদ্দেশ্যে সল্টলেকের নানা জায়গায় খোলা মাটির উপর চাপছে কংক্রিটের প্রলেপ। তার উপর চাপছে আধুনিক টাইলস। তাতে কার কী সুবিধা হচ্ছে জানা নেই ( কিংবা হয়তো জানা আছে)। আপনি বলছেন আমার তাতে কিসের জ্বালা? আচ্ছা তাহলে বলি।
সল্টলেকের খেলার মাঠ এবং খোলা জায়গা গুলো নিয়ে উন্নয়নের নামে যে ছেলেখেলা চলছে তার কিছু উদাহরণ দিই।
ক) খেলার মাঠের ভিতরে সুন্দর ভাবে হাঁটার এবং ছোটার ট্র্যাক করা আছে। বয়স্কদের জন্য বসার জায়গাও আছে। অনেক জায়গায় সুন্দর ভাবে বাঁধানো দ্বিতল কমিউনিটি সেন্টার ও আছে। তা সত্বেও মাঠের চার দিকে যেই খোলা মাটিতে বৃক্ষ গুলো দাঁড়িয়ে আছে সেই মাটিতে ইঁট, কংক্রিট ফেলে তার উপর টাইলস দিয়ে বাঁধিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমফান ঝড়ে পরে যাওয়া গাছ গুলো কে সুন্দর ভাবে JCB দিয়ে তুলে ফেলে সেই জায়গা বাঁধিয়ে দেয়া চলছে (ছবি সহ প্রমাণ আছে বি কে পার্ক-এ)। যে কটা গাছ অবশিষ্ট আছে সেগুলোকে কোনো মতে দুই ফালি জায়গা ছেড়ে চার দিক দিয়ে ঢেলে দেয়া হচ্ছে কংক্রিট।
এক একটি মাঠে এই খোলা মাটির আয়তন খুব কম হবেনা। এক একটি মাঠের পরিধি তিনশো থেকে চারশো মিটার বা তারও বেশি। ট্র্যাকের ভেতর খেলার মাঠ। ট্র্যাকের এবং বাইরের পাঁচিলের মধ্যে খোলা মাটির অংশ চওড়ায় প্রায় আট ফুট এবং তা চলছে মাঠের চার ধার জুড়ে ।
বড় গাছ ছাড়াও এই জমিতে বড় গাছের চারা জন্মায়। বিভিন্ন জংলী ফুল ও ঘাস জন্মায়। সেই ফুলে এবং ঘাসে প্রজাপতি আসে। ফড়িং, ব্যাঙ এবং বিভিন্ন্য পোকা মাকড়ের দেখাও মেলে এই সব বড় গাছের নিচ দিয়ে। তাতে কী এসে যায়? আসছি তাতে।
১। অযথা মাটি বাঁধিয়ে দেওয়া পরিবেশের জন্যে খারাপ। মাটির তলার জলের পরিমাণ এমনিতেই কমে যাচ্ছে। কংক্রিটের ওপর বৃষ্টির জল মাটি চুঁইয়ে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর অবধি পৌঁছাতে পারছে না। নেমে যাচ্ছে মাটির তলার জলের স্তর। উল্টোদিকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে ড্রেন দিয়ে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে নালায়। নালা গুলো ভর্তি হয়ে শহর ভেসে যাচ্ছে। শহরে বন্যা হলে ভগবানকে ডেকে লাভ নেই। ভগবান এমনিই আপনার কাজ কর্ম দেখে ছিলিম টানতে টানতে হাসছেন।
২। গাছের গোড়ায় জল এবং খাদ্য পৌঁছাতে পারছে না। অবশিষ্ট গাছ গুলো দূর্বল হয়ে পড়ছে। তাতে অবশ্য কারুর কিছু যায় আসে না। শহর ঝক ঝকে হচ্ছে সেটাই বড় কথা।
৩। কিন্তু মুশকিল আরো বাড়ছে। বড় বড় গাছের তলা পাতাঝরার সময় প্রচুর শুকনো পাতায় ভরে যায়। সেগুলো সময়ের সাথে সাথে জলে মাটিতে মিশে যায়। গাছকেও খাদ্যও জোগায়। বাঁধিয়ে দেয়া টাইলসএর ওপর পরে থাকা শুকনো পাতা ঝাড়ু মারতে রোজ ঝাড়ুদার আসবে কী ? না হলে টাইলসের ওপর সেগুলো পচে একটা পিচ্ছিল পরিবেশের সৃষ্টি করবে। শুকনো পাতার আবর্জনা ফেলা হবেই বা কোথায়?
৪। গাছের তলার জমিতে জন্মায় বিভিন্ন ঘাস এবং জংলী ছোট গাছ। বাস করে বিভিন্ন রকমের কীট-পতঙ্গ। প্রজাপতি, ফড়িং, গিরগিটি, ব্যাঙ এর ও দেখা মেলে। কংক্রিট ঢেলে দিলে এদের দেখা যে আর মিলবে না তা বলে দিতে হয় না। তখন না হয় পরের প্রজন্মকে ব্যাঙ দেখাতে (সরি, frog দেখাতে) চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবেন। তবে ভারসাম্যতার সূক্ষ্য সুতোর টান পড়বে পাখিদের ওপরেও। সব পাখি গাছে গাছে উড়ে শীষ দিয়ে দিয়ে ফল খায় না। অনেকে গম্ভীর ভাবে মাটির ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে পোকাও খায়। যাকে বলে strictly নন-ভেজেটেরিয়ান। আর প্রায় সব পাখির বাচ্চাকেই শুধুমাত্র পোকাই খাওয়ানো হয়। তো আপনারা তো সামান্য পাখির বাচ্চার খাবারের জোগাড়টুকুও রাখছেন না।
৫। মাটিতে পরে থাকা বীজ থেকে প্রচুর গাছ আপনি জন্মায়। গাছের দোষ নয়, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সেটি আর হবার জো নেই। মাটিই নেই। সুতরাং নতুন করে পরের প্রজন্মের গাছ জন্মাবার জায়গাও নেই। আর আপনি তো আপনার বেতো শরীর নিয়ে কংক্রিট খুঁড়ে নতুন করে গাছ লাগাতে যাবেন না। মাটি থাকলে তাও দুটো বাচ্চা না হয় মাটি খুঁড়ে গাছ লাগালেও লাগাতে পারতো।
৬। পোকা শহরে কমে যাচ্ছে বলে উৎফুল্ল হবেন না। সারা পৃথিবী জুড়ে পোকা কমে যাওয়ায় সবাই খুব চিন্তিত। পোকা কমে গেলে আপনার খাবারে টান পড়তে পারে। মাথা না চুলকিয়ে ক্লাস নাইনের বায়োলজির বইটা থেকে পরাগায়ন বা পলিনেশনটা একবার ঝালিয়ে নিন। পোকা এবং আপনার খাবারের মধ্যে সম্পর্কটা মনে পড়ে যাবে।
৭। অযথা পয়সার অপচয়। টাইলস, কংক্রিট এবং ইঁট এ যেই টাকাটা খরচ হচ্ছে তা নিশ্চিত ভাবে আরো ভালো কাজে লাগানো যেতে পারে। মাঠের ভেতর কেউ টাইলসের ওপর শুতে যাবে না।
খ। এবার আসি ফুটপাথ-এ । বিভিন্ন ফুটপাথ বাঁধিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন ফুটপাথও বাঁধানো হচ্ছে যেখানে কস্মিনকালে কেউ ফুটপাথে হাঁটে না। তার ফলে নতুন করে গাছ লাগানোর জায়গা কমে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়। ঝড়ে পড়ে যাওয়া বিভিন্ন গাছ বা আপনি শুকিয়ে মরে যাওয়া বিভিন্ন গাছের জায়গা গুলো কিন্তু ফাঁকাই থেকে যাচ্ছে। মানে ফাঁকা থাকছে না। তার উপর টাইলস চেপে যাচ্ছে। দেখলে আর বোঝার জো নেই যে সেই স্থানে একদিন একটা বড় গাছ দাঁড়িয়ে ছিল।
বাঁধানো ফুটপাতে যদি মানুষ না হাঁটে তবে তা কিসের কাজে লাগছে। অনেক রকম কাজে লাগছে। যেমন ছোট ষ্টল বসানো হচ্ছে। খাবারের দোকানের সামনে টেবিল চেয়ার পেতে দোকানের আয়তন বাড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন্য দোকানের সামনে মালের স্টক রাখা হচ্ছে। দামি গাড়ি রাস্তায় না ফেলে রেখে ফুটপাথে তুলে রাখা হচ্ছে (হ্যাঁ, ছবি আছে)। পান বিড়ির ষ্টল লাগানো হচ্ছে। বড় গাছ বাড়ির সামনে ফুটপাথে রাখার বড় হ্যাপা। ফুটপাথটা পুরো আগলে রাখে।
এর থেকেও দুঃখজনক যেই ভাবে গাছগুলোর চার ধার দিয়ে বাঁধানো হচ্ছে। এক চিলতে মাটিও ছাড়া হচ্ছে না। জল, খাদ্য এবং হাওয়া শেকড়ে কী ভাবে পৌঁছাবে ভাবার দরকার নেই। (ছবি আছে, পরে দেব)।
গ। এবার আসি খালের ধারে। সল্টলেক ও VIP রোডের মাঝে অবস্থিত খালের ধারে বেশ কিছু কিলোমিটার ধরে টানা বড় গাছ এবং ঝোপ-ঝাড়ের জঙ্গল আছে বা ছিল। যাকে বলে মনোরম পরিবেশ। জানা ছিল সেটি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আওতায়। কিন্তু বড় গাছগুলোকে কেটে, ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করে বানিয়ে দেয়া হলো পার্ক। কারা যায় সেই পার্কে? কেউ না। সল্টলেকে কি পার্কের কোনো কমতি আছে? তবে এখন আলো জ্বলে এই জঙ্গলের ভেতরে এবং হাঁটবার রাস্তাও বানানো হয়ে গেছে ।
ঘ। গ্রীন-ভার্জটা ধরি এবার? সল্টলেকের প্ল্যান-এর মধ্যেই ছিল এই গ্রীন-ভার্জ। অনেকটা জায়গা জুড়ে টানা বড় গাছের জঙ্গল। উদ্দেশ্য ছিল সেগুলো অক্সিজেন দেবে এবং জীব-বৈচিত্র বজায় রাখবে। যারা এই গ্রীন-ভার্জের ধারে বাড়ি করেছিলেন তারা অবশ্যই জানতেন যে বাড়ির পাশে জঙ্গল থাকবে। এহান গ্রীন-ভার্জ ও রক্ষা পায়নি। কাটা পড়েছে বহু বড় গাছ। চাপানো হয়েছে কংক্রিট। বানানো হয়েছে পার্ক যার কোনো দরকার ছিল না। বসানো হয়েছে দোকান। কার স্বার্থে? জানা নেই।
অনেক বছর হয়ে গেলো সল্টলেকে। অনেক কিছু দেখে না দেখার ভান করে এড়িয়ে গেছি। এখনো চাইলে ঠান্ডা ঘরে বসে বা দূরে কোনো জঙ্গল এ বসে হয়তো সময় কাটিয়ে দিতে পারি। কিন্তু ভেতর থেকে খোঁচা দেয়। তাই চারিপাশে যা ঘটছে সেটা আপনারা স্বাভাবিক মেনে নেবার আগে একটুখানি লিখে ফেললাম। আপনি আমার সাথে একমত না দ্বিমত তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। যেটা হচ্ছে সেটা যে ভালো হচ্ছে না তা নিয়ে আমার মনে কোনো সংশয় নেই। আস্তে আস্তে সবাই টের পাবেন। সবুর করুন।
Leave a Reply